লে-লাদাখ, ভারতের উত্তর-সীমান্ত রাজ্য জম্মু কাশ্মীরের এক স্বশাসিত ভূখণ্ড। সিন্ধু উপত্যকার এই নয়নাভিরাম ভূখণ্ডে ভ্রমণ-পরিকল্পনা, ও তা সফল ভাবে সম্পন্ন করা; হয়ে রইল জীবনের এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। পর্যটনের সেই অভিজ্ঞতার কথা রইল প্রথম ভাগে…
দু-দিন আগে ছবির মত উধমপুরের পাহাড়ী রেলস্টেশন থেকে আমাদের বাস যাত্রা শুরু হয়ে ছিল বটে, কিন্তু আজ ২৩শে, মে ২০১৩, শ্রীনগর থেকে কার্গিল-লে অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম এক বর্ষণ-বিঘ্নিত সকালে। আকাশ-জোড়া কালো মেঘ থেকে অবিরাম গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছাঁট মাথায় করে রওনা হওয়ার সময় মনটা কিন্তু বেশ দমে গিয়েছিল। সোনামার্গ-এর মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক শোভা মেঘ-বৃষ্টির দুষ্টুমিতে বিবর্ণ। উপত্যকার শেষ প্রান্তে অনেকটা নীচে অমরগঙ্গার ফুঁসে ওঠা ধারা ঘেঁষে এক টুকরো সবুজ সমতল ভূমি- বালতাল। ওখানে বেশ কিছু তাঁবু, গাড়ির আস্তানা। অমরনাথ যাত্রা-র উত্তর দিকের পথ এখান থেকেই শুরু হয়েছে। বালতাল-কে ডাইনে রেখে জোজিলা গিরিপথ ধরার মুখেই রাস্তায় সার সার গাড়ির অনড় লাইন। কি ব্যাপার! উল্টো দিক থেকে আসা কোনও গাড়ির চালক আলগা করে শুনিয়ে গেল, আগে ধস নেমেছে, সাফাইয়ের কাজ চলছে, রাস্তা কখন ক্লিয়ার হবে তা অনিশ্চিত। ঘণ্টা খানেক পরে অবশ্য গাড়ির সারি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। তিনটে ছোট বাসের কনভয় আমাদের। সন্তর্পণে জোজিলার পথ ধরে এগোতে লাগল। সাড়ে এগারো হাজার ফুট উচ্চতার এই পাহাড়ী গিরিপথটুকুর হাল বড়ই করুণ। রাস্তা জুড়ে কেবল ছোট বড় জলাশয়, পথের ধারের কোনও নিশানা-ই দেখা যায় না। তার উপর ঘন মেঘেরা পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দৃশ্যমানতা পাঁচ-সাত ফুটে নেমে গেছে। দুপুর এগারোটাতেই ঘোর অন্ধকার। উল্টো দিকের গাড়িকে সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে বাসের চালক কি ভাবে যে বাঁকের পর বাঁক গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলল সেটাও রহস্য। বাসের সবাই তখন সিট আঁকড়ে ইষ্টনাম জপছে।
ছবি: জোজিলায় চাক্কা জ্যাম
শ্বাসরোধকরা একটি ঘণ্টা। অবশেষে জোজি-লা পেরিয়ে (১১,৫০০ ফুট) খানিকটা ভদ্রস্থ পিচের রাস্তার দেখা পেলাম। আরও ঘণ্টা খানেক পরে এক চেকপোস্টের সামনে পৌঁছলাম। সেখান থেকে দ্রাস মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে, কারগিল ৮৫ কিলোমিটার, জাসকার ৩০৯ কিলোমিটার ও লেহ ৩১৯ কিলোমিটার দূরে। লাদাখ হিল কাউন্সিল শুরু এখান থেকেই, শুরু হল কারগিল উন্নয়ন পর্ষদের এলাকা। প্রয়োজনীয় বৈধ অনুমতি পত্র দেখানোর পর এগনোর অনুমতি মিলল। আধ ঘণ্টা পর আমরা পূব-পশ্চিমে বিস্তৃত দুই পাহাড়-সারির উপত্যকায় পৌঁছে গেলাম। ক্রমেই দু-পাশের পাহাড় সারি দূরে সরে যেতে লাগল। এখানে শ্রীনগর-লে জাতীয় সড়ক বেশ মজবুত, চওড়া ও সমতল। অল্প সময়ের মধ্যে দ্রাস পৌঁছে গেলাম। মনুষ্য বসবাসকারী, পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম স্থান দ্রাস (১০,৫৯৪ ফুট), শীতকালে পুরোপুরি বরফে ঢেকে যায়, তাপমাত্রা নেমে যায় -৪০℃ পর্যন্ত। তবে এখন মেঘ সরে গিয়ে আলো ফোটার তোড়জোড় চলছে। এদিকে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে বরফ-গলা মাসকোহ্ নালা (লাদাখ অঞ্চলে নদ-নদীকে “নালা” বলা হয়) মিশেছে গিয়েছে গুমবার নালা-য়। গ্রামটির স্থানীয় নাম মাসকোহ্ উপত্যকা। উত্তর দিক বরাবর একে একে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে টাইগার হিল (১৩,৬৪০ ফুট), তোলোলিং (১৫,০৫৫ ফুট) ও আরও অনেক নাম না জানা শৃঙ্গ। ওই পাহাড় চূড়োগুলোই দখল করে বসেছিল পাকিস্তানী হানাদারেরা। ভারতীয় স্থল সেনা ও বিমান বাহিনী মিলিতভাবে তীব্র লড়াই-এর (জুলাই ১৯৯৯) পর তাদের হটিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি পুনরায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। পরবর্তীকালে এখানেই কারগিল যুদ্ধের শহীদ-স্মারক গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে জ্বলছে অনির্বাণ জ্যোতি। এক সেনা অফিসার, উপস্থিত ভ্রমণার্থীদের কারগিল যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সাবলীল হিন্দিতে শোনালেন। শহীদদের স্মরণে সকলেই তখন নতজানু।
ছবি:কারগিল
আবার শুরু হল আমাদের পথ চলা। কারগিল এখনও ৬০ কিলোমিটার দূরে। বাইরে ততক্ষণে মেঘের দল-কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সূর্য উঠেছে হাসি মুখে।। এতক্ষণ পথের বাঁদিক দিয়ে বয়ে চলা গুমবর নদীর নাম পাল্টে এখানে হয়েছে দ্রাস নদী। কারগিল শহরের কিছুটা আগেই একটি নদী সঙ্গম আছে। পথের বাম ধার ধরে ছুটে চলা দ্রাস নালা আর ডান দিক থেকে কারগিল শহর ছুঁয়ে আসা সুরু নদী মিশে গিয়ে তেজে বয়ে চলেছে সোজা উত্তর মুখে, পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ভূখণ্ডে। বলা বাহুল্য, মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই ভারত-পাক বর্তমান নিয়ন্ত্রণ রেখা। জাসকর ও সুরু উপত্যকায় অবস্থিত কারগিল শহরটি লাদাখ অঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। শহর-চিরে সুরু নদীর সশব্দ বয়ে চলা, রমজান মাসে একাধিক মসজিদের আজান-ধ্বনি-মথিত এই শান্ত জনপদটিকে দেখা মাত্র ভালো লেগে যায়।
কারগিলে আমাদের রাতের আস্তানাটি ছিল পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে বেশ উঁচুতে। হোটেলের অলিন্দ থেকে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় কারগিল শহর ও নীচ দিয়ে ছুটে চলা নদীর ধারার অনবদ্য দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। সুপ্রাচীন কাল থেকেই কারগিল শহরটি, সিল্ক রুট-এর এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথের ভূমিকা পালন করে এসেছে। চিনের সিকিয়াং থেকে বেরিয়ে এই পথটি কাশগড়, ইয়ারখন্দ, কোটান, কারাকোরাম, লেহ হয়ে এখানে মিশেছে আর পশ্চিমে বামিয়ান (আফগানিস্থান), সমরখন্দ হয়ে চলে গিয়েছে বোমারা। এখানে বালটি উপজাতীয়রাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, ধর্মে মুসলিম।
কারগিল শহর। ছবি
২৬ জুন ২০১৫
সাত সকালেই বেরিয়ে পড়া হল। লে পৌঁছনোর জন্য আজ সারাদিনে ২৩০ কিলোমিটার সড়ক পথ পাড়ি দিতে হবে। সকালের সোনালী রোদে কারগিল শহর ও তার চারপাশের পাহাড় চূড়াগুলি তখন ঝলসাচ্ছে। কারগিল শহর ছেড়ে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার আসার পরে মুলবেক-এর গুম্ফায় পৌঁছানো গেল। ওয়ালা নদীর ধারে একফালি সবুজের সমারোহ। লেহ জাতীয় সড়কের ধার ছুঁয়ে একটি লম্বা প্রস্তর খণ্ড, আমাদের হেঁশেল-এর নোড়া-র মত গড়ন। সেই প্রস্তর খণ্ডের গায়ে খোদাই করা বুদ্ধ মূর্তি, অনেকটা শিব-মূর্তির ধাঁচে গড়া। আরও ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পরে লামায়ুরু গুম্ফা। পথে দু-দুটি গিরিপথ টপকানোর ব্যাপার রয়েছে। প্রথমে পড়ল নামিক-লা (১২৫০০ ফুট)। এটিকে তেমন বিপজ্জনক মনে হল না। শ্রীনগর-লেহ সড়ক পথের সর্বোচ্চ গিরিপথটি হল ফোতু-লা (১৩৪৩২ ফুট)। লামায়ুরু ছেড়ে ২৭ কিলোমিটার দূরে উৎরাই পথে প্রায় ৪০০০ ফুট নেমে আসার পথে সিন্ধু নদের সঙ্গে দেখা হল ছোট্ট শহর খালাস-এ। তারপর ক্রমে ক্রমে সাসপোল, বাসগো। বাসগোর খ্যাতি ফলের বাগানের জন্য। লাদাখের প্রাচীন রাজধানী ছিল এই বাসগো জনপদ। এর পর নিমু- এখান থেকে লেহ আর মাত্র ৩৬ কিলোমিটার দূরে। এখানেই জাসকর নদ ও সিন্ধু নদ মিলে মিশে একটি ধারায় পরিণত হয়েছে।
সামান্য এগোতেই পথের বাঁদিকে পাথ্থর সাহিব গুরুদোয়ারা। কথিত আছে, গুরু নানক ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে ধ্যানে বসেছিলেন। এক দৈত্যের সেটা না-পসন্দ হয়েছিল। পাহাড়ের ওপর থেকে এক বিরাট পাথর গড়িয়ে পিষে মারতে চেয়েছিল নানাককে। কিন্তু নানকের স্পর্শে পাথরটি মোমের মত গলে যায়। নানকের অবয়ব, স্পষ্ট ছাপ দেখা যায় এই শিলা খণ্ডে। পাথরটি উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠিত হয় পাথ্থর সাহিব গুরুদ্বার। বর্তমানে ভারতীয় সেনারা দেখভাল করে। লক্ষ্য করলাম; জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই পথের প্রতিটি সামরিক গাড়ির চালক, গুরুদ্বার-র পাশের বিশাল মাঠে গাড়ি রেখে গুরুদ্বারে মাথা ঠেকিয়ে তবেই এগোয়। এখানকার ভাণ্ডারা থেকে মিলছে গরম চা, বুঁন্দিয়া ও প্রসাদী হালুয়া।
কিছুদূর এগিয়ে আবার চমক। আমাদের গাড়িগুলির গতি হঠাৎ যেন বেশ শ্লথ হয়ে গেল। আগে-পিছে চলা মিলিটারি গাড়িগুলিরও একই রকম অবস্থা। অথচ এখানের পথটি তেমন খাড়াইও নয়। অবশেষে গাড়ি থেমে গেল। জানতে পারলাম, আমরা চৌম্বক পাহাড়ের (Magnetic Hill) পাশ দিয়ে চলেছি। পাহাড়টির তীব্র আকর্ষণ কোনও যানবাহনই এড়াতে পারে না। গাড়ির গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এই আকর্ষণী–সীমানার অংশটুকু পেরিয়ে যেতে হয় সবাইকে। গিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাঁড় করালে, গাড়ি খুবই ধীরে ধীরে গড়াতে থাকে বৃক্ষ-বিহীন নেড়া পাহাড়ের দিকে।
ভারতের এপ্রান্তে সূর্যাস্ত হতে হতে প্রায় ৮টা বেজে যায়, এখনতো সবে বিকেল চারটে বাজে। পৌঁছলাম লেহ (leh) শহরের উপকণ্ঠে। দু-পাশে ধূসর বালু ও ছোট ছোট পাথরে মোড়া ঢালু উপত্যকার বুক চিরে সোজা পুব দিকে চলা শ্রীনগর-লেহ জাতীয় সড়ক রোদ্দুরে উজ্জ্বল। শহরের প্রায় ১০ কিলোমিটার আগে ইণ্ডিয়ান অয়েল-এর রান্নার গ্যাস সিলিণ্ডার ভরার কারখানা আর পেট্রোলিয়াম সামগ্রীর তেল ডিপো। কিছুটা এগিয়েই বিমান-ক্ষেত্র (leh airport)। শহরের মাঝখান দিয়ে উত্তরমুখী প্রশস্ত রাজপথ ধরে পৌঁছলাম নির্দিষ্ট হোটেলে। তখনও অবাক হওয়ার কিছুটা বাকি ছিল। দেখলাম আমাদের ছোট বাস গুলি রাজপথ ছেড়ে লোকালয়ের শীর্ণ পথে ঢুকে পড়েছে। সেই সরু পথে দুটি গাড়ি মুখোমুখি পার হওয়া বেশ কঠিন। স্থানীয়দের বসবাসের পাড়ায় হোটেলের অবস্থিতি দেখতে ঠিক অভ্যস্ত নই। খানিকটা পরে এ-পথ ও-পথ ঘুরে একটা বড়সড় চারতলা বাড়ির কম্পাউণ্ডে এসে দাঁড়াল আমাদের গাড়ি। এখানেই আগামী এক সপ্তাহের আস্তানা আমাদের। হোটেল গোওয়ালিং ইন্টারন্যাশনাল-এর বাঙালন ম্যানেজার প্রত্যেককে স্থানীয় প্রথা অনুসারে গলায় রেশমের উড়ুনি পরিয়ে স্বাগত জানালেন। অত্যধিক উচ্চতা জনিত কারণে লেহর বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণে ঘাটতি। সেকারণেই এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া খুবই জরুরি। প্রত্যেক আগন্তুককে কিছু জরুরী নির্দেশিকা বুঝিয়ে বললেন তিনি। কিছুটা ধীরে চললে, শ্বাসকষ্ট এড়ানো যায়। কিছু জরুরী ওষুধের (যেমন ডায়ামক্স) নামও বলে দিলেন। অতএব আজ অপরাহ্ণে শুধুই বিশ্রাম।
সিন্ধু নদ। ছবি